দেলোয়ার হোসেন,নবীনগর(ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি:
সারাবিশ্বে যখন পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য রাসায়নিক সারের অতিরিক্ত ব্যবহারকে দায়ী করা হচ্ছে, পাশাপাশি বিজ্ঞানের নতুন সংযোজন ন্যানো টেকনোলজির গবেষকদের আবিষ্কার ন্যানো ইউরিয়া সার ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে তখন পিছিয়ে নেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া নবীনগর উপজেলা কৃষি বিভাগ। উপজেলা কৃষি অফিসের ইনোভেশন কার্যক্রমের আওতায় প্রথমবারের ধানের জমিতে ট্রায়াল দেওয়া হয়েছে ন্যানো ইউরিয়া (তরল ইউরিয়া সার)।
ন্যানো ইউরিয়া হলো আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি এক ধরনের তরল ইউরিয়া সার, যেখানে ইউরিয়ার কণাগুলো ন্যানো-আকারে (খুবই ক্ষুদ্র) তৈরি করা হয়। এটি সাধারণ দানাদার ইউরিয়ার তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর। ন্যানো ইউরিয়ার সুবিধা হচ্ছে কম পরিমাণে বেশি কার্যকারিতা সাধারণ ইউরিয়ার তুলনায় অল্প পরিমাণ ন্যানো ইউরিয়াই গাছের চাহিদা মেটাতে পারে। এক লিটার ন্যানো ইউরিয়া প্রায় ৪৫ কেজি দানাদার ইউরিয়ার সমতুল্য কাজ করতে পারে। ফলে কৃষকের সার বাবদ খরচ অনেক কমে। ন্যানো ইউরিয়া দ্রুত গাছের দেহে শোষিত হয়, ফলে গাছ দ্রুত পুষ্টি পেয়ে ফলন বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত দানাদার ইউরিয়া ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ নষ্ট হয় এবং পরিবেশ দূষণ হয়। ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহারে তা কমে আসে। এটি স্প্রে (ছিটিয়ে) করা যায়, মাটিতে দিতে হয় না, ফলে প্রয়োগ সহজ ও দ্রুত।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, ব্রিধান ৯২ ধানের জমিতে প্রথমবারের ন্যানো ইউরিয়া স্প্রে করে। প্রতি শতক জমিতে এক লিটার পানিতে ৪ মিলি ন্যানো ইউরিয়া স্প্রে করে আশাতীত ফলাফল পেয়েছে। চারা রোপণের পর থেকে ধানের বৃদ্ধি পর্যায়ে তিন বার ১৫ থেকে ২০ দিন অন্তর অন্তর এই সার প্রয়োগ করা হয়।
ইব্রাহিমপুর গ্রামের মধ্য পাড়র কৃষক ফরিদা বেগম জানান, কৃষি বিভাগের পরামর্শে এই প্রযুক্তি আমি গ্রহণ করি, জমি তৈরির সময় অন্যান্য সারের সাথে অল্প পরিমাণ দানাদার ইউরিয়া ব্যবহার করি। পরবর্তীতে আর ইউরিয়া সার না দিয়ে তরল ন্যানো ইউরিয়া ১৫ থেকে ২০ দিন পর পর তিন বার পাতায় স্প্রে করি। ধানের ফলন অনেক ভালো হয়েছে। অনেকেই দেখতে এসেছে। এই পদ্ধতিতে আমাদের জন্য সার প্রয়োগ সহজ হবে, আমাদের আর্থিক খরচ ও কমে যাবে।
গ্রামের অন্যান্য কৃষক মোঃ জাহাঙ্গীর, সুমন মিয়া, আতিকুল ইসলাম, নুর আহাম্মদ, মনুমিয়া,মোবারক মিয়া,জাহানার বেগম,হেনা বেগম জমি পরিদর্শন করে জানান, কৃষিতে এই নতুন আবিষ্কার আমাদের জন্য অনেক আনন্দের। বস্তায় বস্তায় ইউরিয়া সার আনা, তা ব্যবহার করা অনেক পরিশ্রম। আমরা জমি পরিদর্শন করেছি রাসায়নিক সার দিলে যা ফলন হয়, তরল ইউরিয়া (ন্যানো ইউরিয়া) একই রকম মনে হচ্ছে।
উপসহকারী কৃষি অফিসার জনাব, গিয়াস উদ্দিন নাঈম জানান, প্রযুক্তিটি মাঠে প্রয়োগ করতে প্রথম থেকেই নিয়ম অনুসারে মাত্রা অনুসারে ব্যবহার করেছি। পাতায় স্প্রে করায় ইউরিয়ার কার্যকারিতা ভালো ছিলো। পাতার মাধ্যমে গাছ তার প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে। দানাদার ইউরিয়ার মতোই এটি গাছের বৃদ্ধি পর্যায়ে প্রয়োজন অনুসারে স্প্রে করতে হয়। যেসকল ধান দীর্ঘমেয়াদি সেখানে তিনবার স্প্রে করতে হয়, নতুবা দুইবার স্প্রে করলে যথেষ্ট, গাছের বৃদ্ধি এবং কার্যকরী কুশি সংখ্যা অনেক ভালো। আশাকরি ভালো ফলন হবে, অনেক কৃষক আগ্রহী হচ্ছে।
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো: জাহাঙ্গীর আলম লিটন জানান, ন্যানো ইউরিয়ার নাইট্রোজেন গাছ মূলত আমোনিয়া বা অ্যামোনিয়াম (NH₄⁺) এবং নাইট্রেট ফর্মে সরাসরি গ্রহণ করে না যেমনটা মাটির ইউরিয়ার ক্ষেত্রে হয়। যা উদ্ভিদের পাতা থেকে শোষিত হবার পর ভেতরে গিয়ে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়। গাছের পাতা এই কণাগুলো শোষণ করে। উদ্ভিদের অভ্যন্তরে এই কণাগুলো ভেঙে গিয়ে নাইট্রোজেন দেয় অ্যামোনিয়াম ও নাইট্রেট আকারে, যা গাছের জন্য ব্যবহারযোগ্য। এই ধাপে ধাপে মুক্ত হওয়া প্রক্রিয়া গাছের জন্য বেশি কার্যকর এবং পরিবেশের জন্যও নিরাপদ। এই প্রযুক্তি নিয়ে সারা বিশ্বে কাজ হচ্ছে, আমরাও এই প্রক্রিয়া জনপ্রিয় করতে কৃষকদের আগ্রহী করে তুলবো।