1. news@dainikalokitonews.com : দৈনিক আলোকিত নিউজ : দৈনিক আলোকিত নিউজ
  2. info@www.dainikalokitonews.com : দৈনিক আলোকিত নিউজ :
সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:৫৪ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
টংগীবাড়ীতে গ্রামের সড়কে হাঁটতে বের হয়ে প্রাণ গেছে ৪ বছরের শিশুর নওগাঁয় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত -১ আহত -৩ সৌদি আরবে গ্রেপ্তার ১৯ হাজারের বেশি প্রবাসী শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসে স্মৃতিস্তম্ভে সরাইল উপজেলা প্রশাসনের শ্রদ্ধাঞ্জলি সিংগাইরে যথাযোগ্য মর্যাদায় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত বীরগঞ্জের ভগীরপাড়ায় চুলার আগুনে দুইটি ঘর পুড়ে ছাই মিয়ানমারে জান্তা বাহিনী ও আরাকান আর্মির ভয়াবহ সংঘর্ষ, বাংলাদেশ সীমান্তে আতঙ্ক কিশোরগঞ্জে ভিসা প্রতারক গ্রেফতার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও বিএনপি নেতার ওপর হামলার প্রতিবাদে দিনাজপুরে বিএনপির বিক্ষোভ মিছিল

বিশ্ববিদ্যালয় একটি সমৃদ্ধ জাতির আলোকিত বাতিঘর

  • প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২৫
  • ৩৮ বার পড়া হয়েছে

ড. আব্দুল ওয়াদুদ.

বিশ্ববিদ্যালয় বলতে আমরা বুঝে থাকি যেখানে বিশ্ববিদ্যার চর্চা করা হয়। “If University is not universal, it is not a university”।
সভ্যতার ইতিহাস, প্রগতির ইতিহাস, মানুষের মানুষ হয়ে উঠার ইতিহাস আসলে বিশ্ববিদ্যালয়েরই ইতিহাস।
কিন্তু দুঃখজনক সত্য হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়কে এখনো আমরা ভাবি নিছক গতানুগতিক তাত্ত্বিক চর্চার ক্ষেত্র হিসেবে, যা শ্রমবাজারের চাহিদা থেকে অনেকটাই দূরে। একদিকে সমাজ চায় সৃজনশীল, নৈতিক ও অভিযোজনে সক্ষম নাগরিক; অন্যদিকে শিল্প ও শ্রমবাজার চায় এমন স্নাতক, যে প্রথম দিন থেকেই নির্দিষ্ট কাজে দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারে। এই দুই প্রত্যাশার মাঝখানে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন দিশাহীন।
দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষার আদর্শ ও স্বল্পমেয়াদি কর্মদক্ষতা তৈরির চাপ—এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতাই উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে ফেলেছে প্রশ্নের মুখে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব কেবল শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি দেওয়া নয়, তাদের চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানবিক বোধের বিকাশ ঘটানো। সৃজনশীলতা, সহযোগিতা, পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই হওয়া ও আজীবন শিক্ষার ক্ষমতা কোনো কোর্সের সিলেবাসে আটকে রাখার মতো বিষয় নয়। এসব গড়ে ওঠে একটি গতিশীল, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক পরিবেশের মাধ্যমে।

বাংলাদেশ বর্তমানে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে রূপান্তরিত হয়েছে শিল্প এবং সেবাচালিত একটি অর্থনীতিতে। অন্যদিকে সময়ের সঙ্গে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে প্রযুক্তি। ফলে উৎপাদন আর সেবার প্রকারেও পরিবর্তন হচ্ছে। উন্নত এবং অনেক উন্নয়নশীল দেশে অত্যন্ত দক্ষ জনবল রয়েছে, যারা এ প্রযুক্তিগত পরিবর্তনগুলো বুঝতে এবং উৎপাদন ও সেবা ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে সক্ষম। তবে বাংলাদেশে যেমন উচ্চ দক্ষতা, উদ্ভাবনী ও গভীরতর চিন্তাভাবনা এবং সমস্যা সমাধান করার দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরি হয়নি, তেমনি মানবসম্পদ তৈরি হয়নি বলে অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য হয়ে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হচ্ছে এবং তাদের বেতন-ভাতাদি বাবদ প্রতিবছর ৫ বিলিয়নের বেশি ডলার দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ দেশের বর্ধমান তরুণ প্রজন্মকে কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার সঙ্গে সজ্জিত করতে পারলে উৎপাদনশীলতা উন্নত করার এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করার সুযোগের একটি উইন্ডো উন্মোচিত হবে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ী ও নিয়োগকর্তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট তৈরির ব্যবস্থা নিতে বলছেন।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অদ্যাবধি তেমন গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে পারেনি। একই সময়ে ইন্ডাস্ট্রিজের সঙ্গে সহযোগী উদ্ভাবনমূলক গবেষণা মূলত অনুপস্থিত থাকায় বৈশ্বিক জ্ঞান অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান প্রতিযোগিতামূলক র‌্যাংকিংয়ে ক্ষুণ্ন ও অবনত হচ্ছে।
কাজেই উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা এবং সেগুলোর সমাধান করা জরুরি প্রয়োজন।

বর্তমানে উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত মোট ৩৫ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৯ শতাংশ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছে।
অথচ এসব বিষয় নিয়ে ইন্ডিয়ায় ৪০ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৪৪ শতাংশ এবং সিঙ্গাপুরে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করে।
কাজেই অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত এসব অতীব গুরুত্বপূর্ণ শাখায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ আরও বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিতে হবে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মূলত সনাতন শিক্ষাদান পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকি। শিক্ষককেন্দ্রিক পাঠদানে শিক্ষার্থীরা কোর্সের উপকরণগুলো সত্যিকারভাবে শিখছে কিনা এবং অর্জিত জ্ঞানের প্রয়োগে দক্ষতা অর্জন করছে কিনা, সে বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে শুধু তাদের কোর্সের উপকরণ সম্পর্কিত জ্ঞান বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়। এখানে শিক্ষার্থীরা নিষ্ক্রিয় লার্নার।
শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় ফলাফল ভালো করার কৌশল রপ্ত করে এবং মুখস্থ ও আবৃত্তি কৌশলগুলো শিখতে অনুপ্রাণিত হয়। শেখার মূল্যায়ন পরিচালিত হয় মূলত লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে। প্রশ্নের সঠিক উত্তর না দেয়ার কারণগুলো পর্যালোচনা করা হয় না এবং কোর্স শিক্ষক গ্রেড প্রদানের মাধ্যমে ছাত্রের মূল্যায়ন করে থাকেন। এ পদ্ধতিতে কর্মজীবনে তারা চিন্তা করার, সমস্যা সমাধান এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ নিয়ে গবেষণা শুরু হয়।
উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্য হতে হবে একাডেমিক শ্রেষ্ঠত্ব এবং ভালো আর্থ-সংবেদনশীল দক্ষতার সংমিশ্রণে শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ ব্যবস্থা সৃষ্টি করা। এটি সম্ভব হলে শিক্ষার্থীরা কাজের জগতের জন্য এবং গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর আরও বিস্তৃত সামাজিক এবং নাগরিক জীবনের জন্য প্রস্তুত হবে।

বর্তমানে বিশ্বের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফলাফলভিত্তিক শিক্ষা (OBE) এবং ছাত্রকেন্দ্রিক শেখার (SCL) মডেলগুলো শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রবর্তন করেছে। আন্তর্জাতিক শিক্ষাদান পদ্ধতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকতা এবং শেখার আধুনিকীকরণ করা দরকার। অন্যদিকে পাঠ্যক্রম সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক বিকশিত হয়েছে এবং আরও গতিশীল প্রকৃতির হয়ে উঠেছে। পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়েছে সামগ্রিকভাবে শিক্ষানবিশদের এবং সমাজের চাহিদা পূরণের জন্য। সনাতন পাঠ্যক্রম শিক্ষককেন্দ্রিক এবং এটি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন জীবন সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করার জন্য প্রস্তুত করে না। সনাতন পাঠ্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বিষয়কেন্দ্রিক। এ পাঠ্যক্রমটি সংরক্ষিত প্রকৃত জ্ঞানের একটি অঙ্গ, যা শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠানো হয় এবং মুখস্থ, আবৃত্তি ও ড্রিলের মাধ্যমে তারা তা আয়ত্ত করে। আর অন্যদিকে আধুনিক পাঠ্যক্রম বিষয় এবং জীবনকেন্দ্রিক উভয় সংমিশ্রণে প্রস্তুত হয়। এটি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন অংশীদারদের মতামতের ভিত্তিতে মানসম্পন্ন শিক্ষা দেয়ার জন্য একটি পরিমাপযোগ্য পরিকল্পনা এবং কাঠামো সরবরাহ করে। এ পাঠ্যক্রমটি শিক্ষার ফলাফলগুলো চিহ্নিত করে, মান ও মূল দক্ষতা- যা ছাত্রদের অবশ্যই পরবর্তী স্তরে অগ্রসর হওয়ার আগেই অর্জনের সামর্থ্যতা প্রমাণ করতে হবে।
শিক্ষক শিক্ষাক্রম বিকাশ, বাস্তবায়ন ও সংশোধন করতে মূল ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাডেমিক সাফল্যের পথে চলার জন্য এ প্রমাণভিত্তিক পাঠ্যক্রমটি একটি রোডম্যাপ হিসেবে কাজ করে। কোনো কোর্সে ছাত্রদের অগ্রগতি মূল্যায়ন পদ্ধতিগুলোও এখন ভিন্ন। বর্তমানে চার ধরনের মূল্যায়ন পদ্ধতি রয়েছে- ডায়াগনস্টিক, ফরম্যাটিভ, বেঞ্চমার্ক (অন্তর্বর্তীকালীন) এবং সামেটিভ। এসব মূল্যায়ন পদ্ধতির উদ্দেশ্য আলাদা, তবে একত্রিতভাবে এসব পদ্ধতি শিক্ষার্থীর একাডেমিক মূল্যায়নে কাজ করে। কাজেই এ শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ মডেলগুলো আধুনিক পাঠ্যক্রম প্রণয়ন এবং শিক্ষার্থীর একাডেমিক কর্মক্ষমতা মূল্যায়নের আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষকদের অবশ্যই জানা এবং জেনে তা প্রয়োগ করা দরকার।

বর্তমানে বাংলাদেশে ৪৪টি পাবলিক, ১০৪টি প্রাইভেট এবং ২টি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। ২০১৬ সালে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৮৬।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃদ্ধি উচ্চশিক্ষায় সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষের সন্তানদের সুযোগকে প্রসারিত করেছে এবং সরকারি তহবিলের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার জন্য সরকারের ওপর চাপ কমাতে সহায়তা করছে।

নিয়োগকর্তাদের প্রত্যাশা থাকে, স্নাতকেরা যেন নির্দিষ্ট সফটওয়্যার চালনা থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানের সব প্রক্রিয়ায় অবিলম্বে অবদান রাখতে পারে। এই বাস্তবতার চাপে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জরুরি ভিত্তিতে বিভিন্ন দক্ষতামূলক কোর্স চালু করছে। এসব উদ্যোগ প্রাসঙ্গিক, তবে প্রায়ই দেখা যায় এগুলো হয়ে উঠছে কোনোমতে কাজ চালানোর কেরামতি, যা শিক্ষার রূপান্তরমূলক ভূমিকাকে ক্ষুণ্ন করছে। কর্মদক্ষতা নিয়ে একটি বড় ভ্রান্তি হলো, অনেকেই মনে করেন পাঠ্যক্রমে কয়েকটি ‘ট্রান্সফারেবল স্কিল’ যোগ করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা এর চেয়ে জটিল। একজন শিক্ষার্থীর চাকরি পাওয়া ও কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকা কেবল তার প্রযুক্তিগত দক্ষতার ওপরই নির্ভর করে না, করে তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পুঁজির ওপরও।

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা খাত ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে মূলত গত দুই দশকে। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবছর কয়েক লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে। নতুন সব বিভাগ, প্রোগ্রাম ও গবেষণার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসার নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তবে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নানা সংকট। যেগুলোর অন্যতম দক্ষ একাডেমিকের ঘাটতি এবং এই সংকট ক্রমাগত প্রকট হয়ে উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কেবল পাঠ্যবইয়ে সীমাবদ্ধ নয়; এর সঙ্গে জড়িত গবেষণা, উদ্ভাবন, জ্ঞান সৃষ্টির সুযোগ এবং শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক মানে গড়ে তোলার দায়িত্ব। কিন্তু পর্যাপ্ত যোগ্য একাডেমিক না থাকলে এসব লক্ষ্য অর্জন কঠিন হয়ে পড়ে; বিশেষ করে, দুনিয়াজুড়ে বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি শিক্ষা এবং কর্ম খাতের পরিবর্তন এত দ্রুত হচ্ছে যে নতুন শাখাগুলোতে দক্ষ শিক্ষকের অভাব দিন দিন বাড়ছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার সিকিউরিটি, বায়োটেকনোলজি, রোবোটিকস কিংবা ডেটা সায়েন্স—এসব ক্ষেত্র বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষা তার নতুন দিগন্তরেখা তৈরি করছে। উন্নত বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এসব ক্ষেত্রে আধুনিক ল্যাবরেটরি, গবেষণা খাতে অর্থায়ন এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রশিক্ষিত প্রফেসর নিয়োগ করে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে নতুন প্রোগ্রাম শুরু হলেও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উপযুক্ত শিক্ষক পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। ফলে অনেক সময় শিক্ষার্থীরা পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয় এবং গবেষণার ক্ষেত্র সীমিত হয়ে পড়ে। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে আমাদের এখনই বিকল্প ভাবতে হবে।
বর্তমান যুগে মুখস্থভিত্তিক শিক্ষা যথেষ্ট নয়। চাকরির বাজারে সফলভাবে আত্মপ্রকাশ করতে হলে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন বাস্তব দক্ষতা, কমিউনিকেশন স্কিল, সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তি, নেতৃত্বের গুণাবলি এবং দলগত কাজের ক্ষমতা। তাই ফলাফলভিত্তিক শিক্ষা বা আউটকামস-বেসড এডুকেশন (ওবিই) আজ অত্যন্ত জনপ্রিয়। শিক্ষার্থীরা তত্ত্বের পাশাপাশি প্র্যাকটিক্যাল স্কিল, সফট স্কিল, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা এবং নেতৃত্বগুণ অর্জন করছে। ল্যাবকেন্দ্রিক শিক্ষা, ইন্ডাস্ট্রি লিংকেজ, স্টার্টআপ সাপোর্ট, ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং এবং ইন্টার্নশিপভিত্তিক শিক্ষা উচ্চশিক্ষাকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিচ্ছে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব প্রযুক্তিকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। বিশ্বজুড়ে কর্মসংস্থানে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডেটা সায়েন্স, রোবোটিকস, সাইবার সিকিউরিটি, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, স্মার্ট গ্রিড, স্বাস্থ্য প্রযুক্তি, বায়োটেকনোলজি এবং বিজনেস অ্যানালিটিকসের মতো ক্ষেত্র যুক্ত হচ্ছে। প্রযুক্তি কেবল চাকরির ক্ষেত্র নয়, উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রেও অসীম সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই স্টার্টআপ শুরু করছে, গবেষণা প্রকল্পে যুক্ত হচ্ছে বা উদ্ভাবনী সমাধান তৈরি করছে। তাই বিষয় নির্বাচন করার সময় শিক্ষার্থীদের উচিত ভবিষ্যৎ চাকরির বাজার, নিজস্ব আগ্রহ, প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের সম্ভাবনা এবং উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিনিয়র একাডেমিক সংকট করুণ এক বাস্তবতা। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে পর্যাপ্ত শিক্ষক তৈরি হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিতসংখ্যক শিক্ষক থাকলেও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন গবেষণা ও অভিজ্ঞতার অভাব থেকে যাচ্ছে। এতে করে শিক্ষার্থীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি গবেষণা কার্যক্রমও দুর্বল হয়ে পড়ছে। বিদ্যমান শিক্ষকদের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ছে, তাদেরকে একই সঙ্গে ক্লাস নেওয়া, গবেষণা পরিচালনা, থিসিস তত্ত্বাবধান এবং প্রশাসনিক কাজ সামলাতে হচ্ছে। ফলে অনেকে গবেষণায় মনোনিবেশ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। স্বাভাবিকভাবেই উচ্চশিক্ষার গুণগত মান কমে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই। একটি ফলপ্রসূ সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাস্টারিং এবং একাডেমিক এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি নেটওয়ার্ক সিকিউরিটি অথবা যেকোনো একটি বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর থাকেন, তাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় পাঠদানের আমন্ত্রণ করতে পারে। একইভাবে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা অন্য কোনো বিষয়ের
একজন দক্ষ প্রফেসর থাকেন, তবে তিনিও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াতে পারেন। এভাবে পারস্পরিক সহযোগিতা ও শিক্ষক বিনিময়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা পাবে এবং কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর এককভাবে চাপও পড়বে না। এ ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেও একটি বৃহত্তর পরিবারে পরিণত হতে পারে। শিক্ষকেরা নিজেদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান ভাগাভাগি করতে পারবেন, শিক্ষার্থীরা বহুমাত্রিক শিক্ষা লাভ করবে এবং উচ্চশিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশ সমৃদ্ধ হবে। একই সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি অধ্যাপকদেরও আংশিক সময়ের জন্য যুক্ত করা যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থীরা দেশেই আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা পাবে এবং উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন কমে আসবে।

শিক্ষার মান নিশ্চিত করা আসলে জটিল ব্যাপার, এর সঙ্গে অনেক বিষয় সম্পৃক্ত। এটা অর্জন করা কঠিন কিন্তু দেশের স্বার্থেই আমাদের এ কঠিন চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।
শিক্ষা-দর্শনে একটি মৌলিক মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। শিক্ষাকে ‘পণ্য’ এবং শিক্ষার্থীকে ‘ভোক্তা’ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বাদ দিতে হবে। শিক্ষাকে দেখতে হবে একটি যৌথ সামাজিক বিনিয়োগ ও অংশীদারত্ব হিসেবে। যেখানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিল্প ও সমাজ মিলিতভাবে ভবিষ্যতের নাগরিক গড়ে তোলে। রূপান্তর ও লেনদেন—এই দুই শক্তির টানাপোড়েনকে সৃজনশীলভাবে কাজে লাগিয়েই উচ্চশিক্ষা এমন স্নাতক তৈরি করতে সক্ষম হবে, যারা শুধু চাকরির বাজারেই সফল হবেন না, বরং আগামী দিনের বিশ্বকে নতুনভাবে গড়ে তুলতেও তারা নেতৃত্ব দেবেন।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হবে জ্ঞানের বাতিঘর, কিন্তু তারই নিচে অন্ধকার রেখে তো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বমানের শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সর্বোচ্চ ফল পেতে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক শিক্ষার সমাপ্তির পর মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজের শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজানো দরকার। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সঙ্গে সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে সেটি আশা করা যায়। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কোনো উচ্চ মার্গীয় বিমূর্ত ধারণা নয়। বিশ্ব পরিমণ্ডলে দৃশ্যমান কাঠামোয় বিরাজমান বাস্তবতায় জ্ঞানের যে পুঞ্জীভূত নিদর্শন জমা হয়ে আছে, তারই সরল বহিঃপ্রকাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যমে ফুটে ওঠে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ক্রমে জ্ঞানার্জনের পথে হাঁটতে হয়, এখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী একে অন্যের পরিপূরক। শিক্ষকের পাঠদান থেকে শিক্ষার্থী যেমন জ্ঞান লাভ করবেন, তেমনি শিক্ষার্থীর উত্থাপিত প্রশ্নের ফলে একজন শিক্ষকও নতুন কিছু জানার সুযোগ পাবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় ‘সিনিয়র স্কলার’ এবং ‘জুনিয়র স্কলার’ ধারণাটি এভাবেই তৈরি হয়েছে। যুগ বদলে যাবে, শিক্ষার কাঠামোয় পরিবর্তন আসবে, এর সঙ্গে মিল রেখে বিশ্ববিদ্যালয়কেও এগিয়ে যেতে হবে। তবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যুগোপযোগী শিক্ষার ধারণা কাঙ্ক্ষিত পূর্ণতা পাবে।

লেখক : ফিকামলি তত্ত্বের জনক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক,
ওয়াইল্ডলাইফ বিশেষজ্ঞ।

আরো সংবাদ পড়ুন

পুরাতন সংবাদ পড়ুন

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০৩১  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ,কলাম,তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।
ওয়েবসাইট ডিজাইন : ইয়োলো হোস্ট