গ্রামাঞ্চলে শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এখন সবচেয়ে সহজলভ্য বিক্রয় পণ্যে রুপান্তর করার বিষয়টি খুবই ন্যক্কারজনক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এলাকার সবচেয়ে ঘৃনিত চরিত্রের অসভ্য বখাটে ছেলেটা এখন ইউনিয়ন বা ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতা, মাত্র একটা বড় অংকের অর্থের বিনিময়ে। যাদের চৌদ্দ গুষ্টির কেউ কোনদিন আওয়ামী লীগের নাম মুখে নেয়নি, তারা এখন রাতারাতি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক। আর যারা দলের দুঃসময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করে দলকে এগিয়ে নিয়ে গেছে তারা যেন রাজনীতির অঙ্গনে অসহায় শরণার্থী। সময়ের ব্যবধানে পারিবারিক সব ইতিহাস ও ঐতিহ্য এখন নব্য হাইব্রিড আওয়ামীলীগারদের পদাঘাতে বিলীন হচ্ছে নিরন্তর। যারা উঁচু গলায় সমাজে কথা বলতে সাহস করতো না, বংশানুক্রমে তারা সবাই এখন পদধারী এবং বড় বড় সামাজিক অবিচার ও অবক্ষয়ের নাটের গুরু । মদ, জুয়া, গাঁজা, ইয়াবা ইত্যাদি মাদক সেবন ও বাণিজ্য যেন স্বাভাবিক নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে তাদের নেতৃত্বে। উঠতি যুবসমাজের নৈতিকতা ও সামাজিক শৃঙ্খলা নেই কোথাও। সম্মানিত মানুষেরা মুখ বুজে নিজের ইজ্জত বাঁচাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা এখন সেই সব বখাটে ও মূর্তিমান আতঙ্ক নেতাদের দয়ার উপর নির্ভরশীল। ৭১ এ রাজাকারদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এলাকার সরকারি দলের দুধের মাছি নেতারা। তারা গোপনে-প্রকাশ্যে পুলিশের সাথে আঁতাত করে নিরীহ মানুষের জন্য গ্যাড়াকল তৈরি করে বড় অংকের অর্থ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে।
সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাটবাজার ও মসজিদের সভাপতি সহ কমিটি এখন এলাকার চরিত্রহীন লম্পট শ্রেণীর বদমাশ ও সদ্য টাকাওয়ালা অর্থলিপ্সুদের দখলে। এমনকি মসজিদ পর্যন্ত টাকা আয়ের হাতিয়ারে রুপান্তিত হয়েছে । শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানেই নিয়োগ বানিজ্য ও মাসোহারা ভাগাভাগি।
যারা যুবতি মেয়ের বাবা তারাই শুধু জানেন, ঘরে যুবতী মেয়ে নিয়ে কতখানি শ্বাসরুদ্ধকর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বিগত বছরগুলোতে এক শ্বাসরুদ্ধকর শ্বাপদসংকুল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী। তৃণমূল পর্যায়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার চিত্র প্রায় একই। শতশত যুবক ও যুবতীরা অন্যায় অত্যাচারের শিকার হয়েছে , যাদের মা বাবাদের বুক ফুটে কান্নার শব্দ টুকু উচ্চারণ করতেই মানা। ২২-২৫ বছর বয়সী সন্তান হারা মায়ের আর্তনাদ শুনেছেন কখনো?
এলাকার রাস্তার মোড়ের দোকানদার, এনজিওর দাদন নেওয়া সেই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, রিকসা-বাইসাইকেলের মিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রী, মুদি দোকানের মালিকেরা এখন অনেকেই জঙ্গি মামলার আসামি হয়ে এলাকা ছাড়া। তাদের পরিবারগুলো অনাহারে হাহাকার করছে। সন্তান ও স্ত্রী অনাহারে, যুবতি কন্যা ও কমবয়সী স্ত্রীকে বখাটে নেতার লোলুপ দৃষ্টিতে পুড়ে ছারখার হতে হতে অস্ফুটে উচ্চারণ করতে হচ্ছে। পবিত্র কুরআনের সুরা নিসার সেই বিখ্যাত আয়াত, “অমালাকুম লাতুক্কতিলুনা ফি ছাবিলিল্লাহি অল মুসতাদ”,…….”নির্যাতিত নারী ও শিশুরা চিৎকার করে বলছে, হে প্রভু, তোমার সাহায্য কতদূরে”?
তাদের কাছে পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, বিমানবন্দর, এক্সপ্রেসওয়ে ইত্যাদির মূল্য কত, ওরা কি তা ব্যবহার করে কোনোদিন? তাছাড়া ঢাকা থেকে পদ্মাসেতু পার হয়ে ওপারে যাওয়ার সময় গর্বে বুকটা ভরে ওঠে ঠিকই, কিন্তু এলাকায় গিয়ে মানুষের হাহাকারে তা বিলীন হয়ে যায় মুহূর্তেই।
যারা এলাকার মধ্যবিত্ত মানুষ, পারিবারিক ঐতিহ্যের ও সম্মানের কারনে বিভিন্ন সময়ে ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ইত্যাদি পদে নির্বাচন করেছে, তারা সবাই এখন মামলার আসামি। জঙ্গি, খুন, ধর্ষন, লুটতরাজ ইত্যাদি মিথ্যা ও ভুয়া মামলায় ছেয়ে গেছে জনপদ। মৃতব্যক্তি, শিশু, বিদেশে কাজ করা শ্রমিক কেউই মিথ্যা মামলার আসামি হতে রক্ষা পাচ্ছে না। কোনো না কোনো সময়ে তাকে জেলে যেতে হয়েছে এবং হচ্ছে। আদালতে কোর্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা এখন তাদের জন্য নিরাপদ নয়। পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থা ও সম্মান বিনষ্টের পাশাপাশি ধ্বংস হয়েছে তাদের অর্থনীতি ও সন্তানের শিক্ষা। চরম হিংসাত্মক ও হিংস্র পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে ইউপি পর্যন্ত দলীয় প্রতীক বরাদ্দ করে। দলীয় প্রতীক পাওয়ার জন্য বিরাট অংকের বাণিজ্য হয়েছে। নেতাদের পকেট ভারি হয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নকে গিলে খেয়ে ফেলেছে তার সহচর প্রভুরা। তারা টাকার বিনিময়ে ভোট করে। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচনে কেউ কেউ ১০০ কোটি টাকার উপরে খরচ করেন। অনেক নেতাদের টাকা খরচ করার স্টাইল, দেশে-বিদেশে সম্পদের ফিরিস্তি শুনলে মনে হয় তাদের নিজস্ব টাকশাল রয়েছে। টাকা পাচারের দুর্বার প্রতিযোগিতা করে, মানুষের অধিকার উপেক্ষা করে, মেগা প্রকল্পের নামে লুটপাট করে, বেগম পাড়া নামক বিলাসবহুল প্রাসাদ তৈরী করে এবং বিচার বিভাগের উপর হস্তক্ষেপ করে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু করে, জাতিকে বিচার প্রাপ্তির অধিকার বঞ্চিত করে, নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিরোধী শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে, শুধুমাত্র দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য লোকদের চাকরি দিয়ে দেশের উন্নয়নের চেয়ে হাজার হাজার গুণ ক্ষতি হয়েছে বলে সাধারন মানুষের মধ্যে বিশ্বাস তৈরী হয়েছে।
সম্প্রতি জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন WFP (ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম) এর জরিপে দেখা যায় বাংলাদেশের প্রায় ৬৮% মানুষ অর্থাৎ প্রায় এগারো কোটি মানুষ খাদ্য সংকটে ভুগছেন। খাদ্যের চাহিদা মেটাতে তাদের ঋণগ্রস্ত হতে হয়েছে এমনকি অনেককে সম্পদ বিক্রি করতে হয়েছে । খাদ্য সংকটের এই অসহনীয় অচল অবস্থার জন্য দায়ী নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত মুষ্টিমেয় অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, দুর্নীতিবাজ কিছু রাজনীতিবিদ ও দুর্নীতিবাজ আমলা। আাবার কিছু জ্ঞানপাপী, রাষ্ট্রদ্রোহী, ষড়যন্ত্রকারী পেছন থেকে কলকাঠি নাড়াচ্ছেন দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট খাদ্য দ্রব্য সরবরাহের বিঘ্নতার কারণে সৃষ্ট জটিলতা হয়েছে মরার উপর খাড়ার ঘা।
এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত ঐতিহাসিক ভুল গুলো মানুষের কাছে প্রকট আকার ধারণ করেছে, সেদিকে নেতাদের কোন খেয়াল আছে বলে মনে হয় না। সরকারের বিরোধিতা করছে এক বিশাল জনগোষ্ঠী। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দরা কি বধির হয়ে গেছেন? তাদের কর্ণকুহরে কি সাধারণ মানুষের আর্তনাদ প্রবেশ করছে না?
বঙ্গবন্ধুর একজন আদর্শের সৈনিক হয়ে আমার সমালোচনায় অনেকে ক্ষুব্ধ হবে জানি। কিন্তু প্রকৃত সত্য বিভিন্ন দুর্নীতি ও স্বজন প্রীতির জন্য আওয়ামী লীগ সরকার দিনে দিনে তার জনসমর্থন হারাচ্ছে।
স্বজন হারানোর হাহাকার আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে ফিরে এসে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাল ধরেছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের। নতুন করে সূচনা করেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের সংগ্রাম। অনেক ঘাম, শ্রম আর রক্তের বিনিময়ে আজ বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনাময় দেশ, উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কতিপয় সুযোগ সন্ধানী, সুবিধাবাদী, দুশ্চরিত্র, দুর্বৃত্তের জন্য যুগ যুগ ধরে তিল তিল করে অর্জিত বাংলাদেশের অর্জনকে কিছুতেই বিসর্জন দেওয়া যায় না।
আমার অকুণ্ঠ বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু থাকলে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি বারবার বিভ্রান্ত হয়ে অনিশ্চিত অন্ধকারের দিকে ধাবিত হতো না। বঙ্গবন্ধুর রক্ত এবং আদর্শের সুযোগ্য উত্তরাধিকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কঠোর হস্তে সর্বাত্মক সংস্কার করে দুর্বৃত্তায়নের রাহু গ্রাস থেকে প্রাণপ্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে মুক্ত করবেন এবং বাংলাদেশের রাজনীতিকে করবেন পরিশুদ্ধ। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যেমন প্রয়োজন তেমনি দুর্নীতির লাগাম টেনেধরা একান্ত জরুরী। বিভিন্ন দল ও মতের অংশগ্রহণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন না হলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করবে ও উন্নয়ন ব্যাহত হবে। তাই বিরোধী দল ও মতের প্রতি আরো সহনশীল আচরণ বঙ্গবন্ধুর মতো উদার নেতার উত্তরাধিকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রত্যাশা।
লেখকঃ ড.আব্দুল ওয়াদুদ
ফিকামলি তত্ত্বের জনক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক,
ওয়াইল্ড লাইফ ও মনোবিজ্ঞান গবেষক