অপু আবুল হাসান,ব্যুরো চিফ সিলেটঃ
ডিসেম্বর মাস বাঙালির জাতীয় জীবনে এক অহংকারের নাম। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর এই মাসেই আমরা অর্জন করেছি বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। কিন্তু বিজয়ের পাঁচ দশক পরেও একটি প্রশ্ন মাঝেমধ্যেই ইতিহাসের অলিগলি থেকে উঁকি দেয়—এই বিজয় কার? এটি কি কেবলই ভারতের সামরিক বিজয়, নাকি সাত কোটি বাঙালির আপসহীন ‘জনযুদ্ধ’?
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ১৯৭১ সালের ঘটনাপ্রবাহকে অনেক সময় ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ’ হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করা হয়, যেখানে বাংলাদেশের জন্মকে দেখা হয় সেই যুদ্ধের একটি ফলাফল হিসেবে। কিন্তু ইতিহাসের নির্মোহ বিশ্লেষণ এবং তৎকালীন ভূ-রাজনীতির সমীকরণ ভিন্ন কথা বলে।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এর প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছিল দীর্ঘ ২৩ বছরের বঞ্চনা এবং বিশেষ করে ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চ মাসে। ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান যখন অধিবেশন স্থগিত করেন, তখন থেকেই মূলত মানসিক বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছিল।
২রা ও ৩রা মার্চ পল্টনের জনসমুদ্রে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ইশতেহার পাঠ এবং ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে জিন্নাহর পতাকার পরিবর্তে সারা বাংলায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন—এ সবই ছিল বাঙালির নিজস্ব স্বকীয়তা ও সাহসের বহিঃপ্রকাশ। এই অধ্যায়গুলোতে ভারতের কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল না; এটি ছিল একান্তই বাঙালির জাগরণ।
মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ব্যবস্থাপনায় তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। তিনি অনুধাবন করেছিলেন, বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না। তাই তিনি দ্রুততম সময়ে মুজিবনগর সরকার গঠন করে এই লড়াইকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন’-এর তকমা থেকে রক্ষা করে একটি বৈধ ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’-এ রূপান্তর করেন। তবে ইতিহাসের এই বাঁকে অভ্যন্তরীণ কোন্দলও ছিল।
ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকীর সাম্প্রতিক তথ্যমতে, যুদ্ধের সময় শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে গঠিত ‘মুজিব বাহিনী’ মূল সরকারের সমান্তরালে অবস্থান নিয়েছিল, যা অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করলেও সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ভাঙতে পারেনি।মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল বিশ্লেষণে দেখা যায়, এটি ছিল পুরোদস্তুর একটি ‘জনযুদ্ধ’। পাকিস্তানের সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কেবল অস্ত্র দিয়ে নয়, বরং সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে তাদের কোণঠাসা করা হয়েছিল।
ভারতের ভূমিকা এখানে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তা নিঃস্বার্থ ছিল—এমন দাবি করা ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় কিছুটা আবেগপ্রসূত। ভারতের জন্য ১৯৭১ ছিল ১৯৪৭-এর দেশভাগের এক মোক্ষম জবাব এবং তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ‘সেভেন সিস্টার্স’-এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সুবর্ণ সুযোগ। পেটের ভেতর শত্রুবেষ্টিত পূর্ব পাকিস্তান ভারতের নিরাপত্তার জন্য সর্বদা হুমকি ছিল। তাই বাংলাদেশকে স্বাধীন করা ভারতের নিজস্ব নিরাপত্তার স্বার্থেই জরুরি ছিল।যুদ্ধের শেষ লগ্নে, অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বর ভারত যখন সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়, ততদিনে বাংলার দামাল ছেলেরা পাকিস্তান বাহিনীকে মানসিকভাবে এবং রণক্ষেত্রে অনেকটা দুর্বল করে ফেলেছিল।
ভারত মূলত এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে বিজয়ের চূড়ান্ত মুহূর্তে ‘ক্রেডিট’ বা কৃতিত্ব নিজেদের ঝুলিতে নিতে চেয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের দলিলে যৌথ বাহিনীর কথা বলা হলেও, সেখানে ভারতীয় আধিপত্য ছিল স্পষ্ট। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে অনুপস্থিতি সেই ক্ষোভ ও অভিমানেরই ইঙ্গিত দেয়। তিনি চেয়েছিলেন, পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করুক সেই মুক্তিবাহিনীর কাছে, যারা নয় মাস ধরে রক্ত দিয়েছে।
পরিশেষে, ১৯৭১ সালে ভারত আমাদের লজিস্টিক, আশ্রয় এবং কূটনৈতিক সহায়তা দিয়েছে এটি অস্বীকার করার উপায় নেই এবং এজন্য আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু দিনশেষে এই স্বাধীনতা কোনো উপহার নয়। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত, মা-বোনের সম্ভ্রম এবং সাধারণ কৃষকের লাঙল ফেলে অস্ত্র ধরার সাহসের নাম বাংলাদেশ।
তাই বিশ্বমঞ্চে যখন এই যুদ্ধকে ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়, তখন আমাদের জোর গলায় বলা উচিত এটি ছিল বাঙালির ‘জনযুদ্ধ’, আর ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় একান্তই বাংলাদেশের।
মোঃ কামরুজ্জামান মিলন
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক তুহিন প্রিন্টিং প্রেস ফকিরাপুল ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
ই-মেইল: 𝐝𝐚𝐢𝐧𝐢𝐤𝐚𝐥𝐨𝐤𝐢𝐭𝐨𝐧𝐞𝐰𝐬@𝐠𝐦𝐚𝐢𝐥.𝐜𝐨𝐦
ই-পেপার: 𝐞𝐩𝐚𝐩𝐞𝐫.𝐝𝐚𝐢𝐧𝐢𝐤𝐚𝐥𝐨𝐤𝐢𝐭𝐨𝐧𝐞𝐰𝐬.𝐜𝐨𝐦
ওয়েবসাইট: 𝐰𝐰𝐰.𝐝𝐚𝐢𝐧𝐢𝐤𝐚𝐥𝐨𝐤𝐢𝐭𝐨𝐧𝐞𝐰𝐬.𝐜𝐨𝐦
মোবাইল: ০১৯২৭-৩০২৮৫২/০১৭৫০-৬৬৭৬৫৪
আলোকিত মাল্টিমিডিয়া লিমিটেড