আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ
ফিলিস্তিনের গাজায় নতুন সামরিক অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। এর মধ্যেই একটি গোপন সামরিক ডেটাবেজ থেকে ফাঁস হওয়া তথ্য প্রকাশ করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, গত দুই বছর ধরে ইসরায়েলের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব নিজেদের জনগণ ও বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করেছে, এমন এক যুদ্ধে যেখানে নিহতদের সিংহভাগই বেসামরিক মানুষ।
হামাস যোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যা কত?
ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা ইউনিটের গত মে মাসে তথ্যসূত্রের বরাতে সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়, হামাস ও অন্যান্য সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠীর যোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত ছিল ৪৭ হাজার ৬৫৩ জন। এদের মধ্যে মাত্র ৮ হাজার ৯০০ জনকে নিহত বা সম্ভাব্য নিহত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অথচ, ইসরায়েলি রাজনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে এই সংখ্যা দ্বিগুণ—প্রায় ১৭ থেকে ২০ হাজার পর্যন্ত দাবি করে আসছিলেন। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, অভ্যন্তরীণ ডাটাবেসে কিছু ঘাটতি থাকলেও প্রকাশ্যে জানানো পরিসংখ্যান ছিল ‘অসত্য ও অতিরঞ্জিত’।
‘ওয়ার ড্যাশবোর্ড’: সাফল্যের ভুল মাপকাঠি
যুদ্ধ শুরুর পরপরই ইসরায়েলের অভিজাত ৮২০০ গোয়েন্দা ইউনিটের তৎকালীন প্রধান ইয়োসি সারিয়েল প্রতিদিন একটি ‘ওয়ার ড্যাশবোর্ড’ পাঠাতেন, যেখানে হামাস যোদ্ধাদের মৃত্যুর সংখ্যা হালনাগাদ করা হতো।
একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা গার্ডিয়ানকে জানান, এই ড্যাশবোর্ড কৌশলগত পরিকল্পনার পরিবর্তে একটি গেমের মতো হয়ে উঠেছিল, যেখানে অফিসাররা সংখ্যা বেশি দেখেই আনন্দ পেতেন।
‘আমাদের ছিল একটি চমৎকার ইন্টার্যাকটিভ ড্যাশবোর্ড,’ বলেন সারিয়েলের এক সাবেক সহকর্মী। ‘কিন্তু আমরা বুঝতেই পারিনি যুদ্ধের প্রকৃত লক্ষ্য কী ছিল।’
হামাস যোদ্ধা নিহতের সংখ্যা ছিল যেন যুদ্ধের একমাত্র উদ্দেশ্য। অথচ কেউ ভাবেননি, যদি হামাস ভেঙে পড়ে তবে গাজার শাসন কে চালাবে, অথবা এই গণহত্যার মাধ্যমে ইসরায়েল কী রাজনৈতিক লাভ করতে চায়।
যুদ্ধের বাস্তবতা: অধিকাংশ নিহতই বেসামরিক
ডাটাবেস অনুযায়ী, ৭ হাজার ৩৩০ জন যোদ্ধার মৃত্যু নিশ্চিত এবং আরও ১ হাজার ৫৭০ জনকে ‘সম্ভাব্য নিহত’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যে দেখা যাচ্ছে—গাজায় প্রতি একজন যোদ্ধার মৃত্যুর বিপরীতে অন্তত চারজন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন।
এই পরিসংখ্যান আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে যখন জানা যায়, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকায় শুধুমাত্র উদ্ধারের পরে শনাক্ত করা মৃতদেহ অন্তর্ভুক্ত আছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া হাজারো মরদেহ এখনও অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
একজন পশ্চিমা সামরিক বিশ্লেষকের ভাষায়, ‘এটি বিজয়ের কোনো সংজ্ঞায় পড়ে না। এটা একপ্রকার নিষ্ফল সহিংসতা, যার কোনো কৌশলগত মূল্য নেই।’
‘হামাস ধ্বংস’ লক্ষ্য কতটা অর্থহীন?
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু শুরু থেকেই বলে আসছেন, ইসরায়েলের লক্ষ্য ‘হামাস ধ্বংস’। কিন্তু এই লক্ষ্য কতটা বাস্তবসম্মত—তা নিয়েই উঠেছে প্রশ্ন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলার মূল পরিকল্পনাকারীদের প্রায় সবাই ইতোমধ্যেই নিহত হয়েছে। হামাসের সামরিক সক্ষমতা কার্যত ভেঙে পড়েছে, রকেট মজুদ প্রায় ফুরিয়ে এসেছে এবং সীমান্তে হামলা চালানোর সক্ষমতাও হারিয়েছে।
ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস-এর বিশ্লেষক মুহাম্মদ শেহাদার মতে, ‘হামাস এখন অন্তত এক–দুই দশক ইসরায়েলের জন্য অস্তিত্বগত হুমকি হয়ে উঠতে পারবে না।’
নতুন অভিযানের ঘোষণা
তবুও, নেতানিয়াহু ঘোষণা দিয়েছেন—গাজা শহরে নতুন একটি স্থল অভিযান চালানো হবে, যার লক্ষ্য ‘শেষ সন্ত্রাসী ঘাঁটি দখল’। কিন্তু সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি আরেকটি ব্যর্থ চেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়।
যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে হামাসের পক্ষেই কৌশলগত সুবিধা থাকবে, কারণ তারা কম অস্ত্র ও সীমিত লজিস্টিকেই দীর্ঘমেয়াদি বিদ্রোহ চালিয়ে যেতে সক্ষম। শেহাদা বলেন, ‘গাজায় বিস্ফোরক সরবরাহের অভাব নেই, আর এই গণহত্যা নতুন সদস্য সংগ্রহের অনন্ত উৎস তৈরি করেছে।’
ইসরায়েলের প্রতারণা
মার্কিন গোয়েন্দা সূত্রের মতে, যুদ্ধ চলাকালে হামাস প্রায় ১৫ হাজার নতুন যোদ্ধা নিয়োগ করেছে—যা ইসরায়েলি বাহিনী দ্বারা নিহত যোদ্ধাদের সংখ্যার দ্বিগুণ।
এমনকি ইসরায়েলের ডানপন্থি রাজনীতিকরাও প্রকাশ্য মৃত্যুর সংখ্যাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ইটঝাক ব্রিক বলেছেন, ‘এটি ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রতারণাগুলোর একটি।’
গত বছরের এপ্রিলে ইসরায়েলি পার্লামেন্টের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা কমিটির সদস্যরা সেনাবাহিনীর কাছে যোদ্ধা হতাহতের তথ্য যাচাই করেন এবং জানতে পারেন—২:১ অনুপাত বজায় রাখার জন্য বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা ইচ্ছাকৃতভাবে কম দেখানো হয়েছে।
সামরিক বাহিনীর প্রতিক্রিয়া
ডাটাবেস ও হতাহতের তথ্যের বিষয়ে যখন স্থানীয় সংবাদমাধ্যম প্রশ্ন তোলে, তখন ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এসব তথ্য অস্বীকার করেনি। তবে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে তারা জানায়, প্রতিবেদনটিতে উল্লিখিত পরিসংখ্যানগুলো ‘ভুল’, যদিও তারা নির্দিষ্ট করে বলে না কোন তথ্যগুলো ভুল।
মোঃ কামরুজ্জামান মিলন
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক তুহিন প্রিন্টিং প্রেস ফকিরাপুল ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
ই-মেইল: 𝐝𝐚𝐢𝐧𝐢𝐤𝐚𝐥𝐨𝐤𝐢𝐭𝐨𝐧𝐞𝐰𝐬@𝐠𝐦𝐚𝐢𝐥.𝐜𝐨𝐦
ই-পেপার: 𝐞𝐩𝐚𝐩𝐞𝐫.𝐝𝐚𝐢𝐧𝐢𝐤𝐚𝐥𝐨𝐤𝐢𝐭𝐨𝐧𝐞𝐰𝐬.𝐜𝐨𝐦
ওয়েবসাইট: 𝐰𝐰𝐰.𝐝𝐚𝐢𝐧𝐢𝐤𝐚𝐥𝐨𝐤𝐢𝐭𝐨𝐧𝐞𝐰𝐬.𝐜𝐨𝐦
মোবাইল: ০১৯২৭-৩০২৮৫২/০১৭৫০-৬৬৭৬৫৪
আলোকিত মাল্টিমিডিয়া লিমিটেড