ড. আব্দুল ওয়াদুদঃ
পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ' পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী বস্তু। আর সেটা যদি হয় ছোট ছোট কোমলমতিদের, তাহলে তা বহন করা আরো দুঃসাধ্য'। ছুটির পর যে স্কুল ক্যাম্পাস থাকত কোলাহলে মুখর, তা ভেসে গেল আর্তনাদে।
২১ জুলাই অন্যান্য দিনের মতো ক্লাস চলছিল। কেউ খেলছিল মাঠে। ঠিক তখনই বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান এফ-৭ বিজিআই বিধ্বস্ত হয় শিক্ষার্থীদের ভবনে। বিধ্বস্ত হওয়া বিমানটির 'নাক' ঢুকে যায় ভবনের সিঁড়িতে। পুড়ে ছাই হয় শিশুদের দুটি ক্লাসরুম। স্কুলের আঙিনা থেকে আগুনে ঝলসে যাওয়া শরীর নিয়ে আট-নয় বছরের শিশু কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এসেছে। তার ইউনিফর্ম পুড়ে দগ্ধ চামড়ার সঙ্গে মিশে গেছে। কী মর্মান্তিক এ দৃশ্য! জানি না কোন মায়ের নাড়িছেঁড়া ধন এই শিশুটি। অবর্ণনীয় কষ্টে কাতর এখন কেমন আছে ছোট শিশুটি? এমনই আরো অনেক শিশু দগ্ধ শরীর নিয়ে কাতরাতে কাতরাতে বেরিয়ে আসে স্কুলের গেটের বাইরে।
১৯৭৩ সালের ভিয়েতনামের রাস্তায় কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে আসা সেই নগ্ন নাপাম বালিকার ছবির কথা মনে পড়ছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসে সেই ছবি ছাপা হলে কেঁপে উঠেছিল বিশ্ববিবেক। মাইলস্টোন বিপর্যয়ে ঝলসে যাওয়া আমাদের শিশুরাও হয়ে উঠেছে গভীর বেদনার একেকটি জ্বলন্ত প্রতিচিত্র। শিক্ষয়িত্রী মেহেরীন নিজের জীবন-মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে আগুনের ভেতর থেকে বের করে এনেছেন। ওদের বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নিজে বাঁচতে পারেননি। একজন আদর্শ শিক্ষক তো এমনই
মহৎপ্রাণ হয়ে থাকেন।
কেউ সহজে ভুলবে না দগ্ধ শিশুদের আর্তনাদ, দিশাহারা শিক্ষক, মৃত্যুপথযাত্রী শিশু ও কিশোরের গোঙানি, সন্তানের খোঁজে দিশাহারা পিতামাতার চোখমুখে সীমাহীন উদ্বেগ। সব মিলিয়ে জন্ম দেয় এক তীব্র বিষাদময় দৃশ্যপটের। উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুর্ঘটনায় সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী মৃত্যুর সংখ্যা ৩৪ জন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিহত শিক্ষার্থীদের একটি তালিকা প্রকাশ করলে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো ফরেনসিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়, পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে, দুর্ঘটনায় নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ৩৪ জন। এর মধ্যে সিএমএইচে মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের
এই শোকাবহ ট্রাজেডি কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি আমাদের রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা, নাগরিক নিরাপত্তা এবং দুর্যোগে দায়িত্বশীল আচরণের প্রকৃত রূপ উন্মোচন করেছে। তবে এই ঘটনার মধ্যেও উঠে এসেছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অসাধারণ মানবিক তৎপরতার চিত্র। আগুন নেভানোর আগেই আশপাশের মানুষ ছুটে গেছে উদ্ধারকাজে। কেউ পানি এনে দিয়েছে, কেউ দগ্ধ শিশুদের হাসপাতালে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে।
আমাদের জাতিসত্তার অন্যতম গৌরব। সত্তরের মানবিক বিপর্যয়ের দিনগুলোতে 'কাঁদো বাঙালি কাঁদো' ব্যানার সামনে নিয়ে মিছিল করে ত্রাণ সংগ্রহ করতে দেখেছি সংবেদনশীল তরুণদের। ১৯৮৬ সালে জগন্নাথ হল ট্রাজেডির খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজারো তরুণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল উদ্ধারকাজে। রানা প্লাজা ধস, কিংবা করোনা মহামারির সময় যেখানেই মানবিক বিপর্যয়, সেখানেই অগণিত মানুষ নিজের স্বার্থ ভুলে বিপদগ্রস্তের পাশে দাঁড়িয়েছে। উত্তরা দুর্ঘটনার পরও আমরা দেখেছি, কত মানুষ রক্ত দিতে ছুটে গেছে বার্ন ইনস্টিটিউটে, খাবার-জরুরি ওষুধ নিয়ে পৌঁছেছে স্বেচ্ছায়। এমনকি হাসপাতালে বসে অচেনা দগ্ধ শিশুর হাত ধরে চোখের পানি ফেলেছে অনেকেই।
মাইলস্টোন ট্রাজেডির পটভূমিতে মানবিকতার পাশাপাশি ভেসে এসেছে কিছু দুঃখজনক ও দৃষ্টিকট চিত্র। দুর্ঘটনার পরপরই একদল রাজনৈতিক নেতানেত্রী ও তাদের অনুসারীরা দলে দলে হাসপাতালে উপস্থিত হয়েছেন। সপ্তবদনশীল পোড়া রোগীদের কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে অনাবশ্যক বক্তৃতা দিয়েছেন, প্রেস-ফটোগ্রাফার নিয়ে এসে 'দুঃখপ্রকাশ'-এর নামে ফটোসেশন করেছেন। এতে হাসপাতালের সুশৃঙ্খল পরিবেশ বিঘ্নিত হয়েছে, দগ্ধ রোগীদের পরিবার হয়ে পড়েছে আরো উদ্বিগ্ন।
মানবিক বিপর্যয় কখনোই রাজনৈতিক ফায়দা তোলার উপযুক্ত ক্ষেত্র নয়। দুর্যোগে দায়িত্বশীল আচরণ মানে কেবল সহানুভূতির ছবি পোস্ট করা নয়, বরং বাস্তব সহায়তা নিশ্চিত করা। অথচ কিছু রাজনৈতিক নেতাকর্মীর আচরণে তা নিছক মিডিয়া শো-য়ে পরিপিত হয়েছে, যা একদিকে দৃষ্টিকটু, অন্যদিকে আহত মানুষদের প্রতি অসম্মানজনক।
ঢাকায় তেজগাঁও পুরোনো বিমানবন্দর এবং কুর্মিটোলা এয়ারবেস-এই দুটির অবস্থান। ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীর আকাশে নিয়মিত যুদ্ধবিমান চক্কর দেওয়া কতটা নিরাপদ? আন্তর্জাতিক সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটি (আইকাও)-এর অ্যানেক্স টু এবং অ্যানেক্স ইলেভেন অনুযায়ী, যে কোনো প্রশিক্ষণ ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে জনবসতিপূর্ণ এলাকার ওপর দিয়ে কম উচ্চতায় উড়ালকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে, ন্যূনতম নিরাপদ অলটিচিউড বজায় রাখা বাধ্যতামূলক, বিশেষ করে ঘনবসতি ও
প্রতীক। কিন্তু বাস্তবে এটি প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে থাকা একটি ঝুঁকিপূর্ণ প্ল্যাটফরম। বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ মিগ-২১ বা তার অনুরূপ মডেলগুলো ফেজ আউট করে ফেলেছে। বাংলাদেশের কাছে এখনো রয়েছে প্রায় ৩৬টি এফ-৭ বিমান, যার বড় অংশই পুরোনো প্রযুক্তির। যুদ্ধবিমান শুধু গতি বা অস্ত্রধারণ ক্ষমতায় মাপা যায় না-এর নিরাপত্তা ও নির্ভরযোগ্যতাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ প্ল্যাটফরমে প্রশিক্ষণ চালানো মানে ভবিষ্যতের কূটনৈতিক এলাকাগুলোর ক্ষেত্রে।
যেসব দেশ জননিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেয়, সেসব দেশের ঘনবসতি এলাকায় সামরিক বা বেসামরিক কোনো বিমান প্রশিক্ষণ হয় না। জাপানে শহরের ওপর প্রশিক্ষণ নিষিদ্ধ, বেশির ভাগ প্রশিক্ষণ হয় সমুদ্রের ওপর বা নির্জন এলাকায়। যুক্তরাষ্ট্র জনবসতির ওপর কম উচ্চতায় প্রশিক্ষণ ফ্লাইটে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। প্যারিস শহরের আকাশে কোনো প্রশিক্ষণ বিমান দেখা যায় না-শুধু বিশেষ অনুষ্ঠানে নির্দিষ্ট অনুমতিতে। ভারতের নয়াদিল্লিতে কম উচ্চতায় সামরিক বিমান নিষিদ্ধ। প্রশিক্ষণ হয় উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্রের বিশাল ঘরানার সামরিক ঘাঁটিতে। যুদ্ধবিমান অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ছোটে। যে কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি বা বৈমানবিকের ভুলে জনবসতিতে বিধ্বস্ত হলে ব্যাপক প্রাণহানি ও ধ্বংস হতে পারে। যুদ্ধবিমানের শব্দ ১২০-১৪০ ডেসিবেল পর্যন্ত হতে পারে, যা দীর্ঘ মেয়াদে শ্রবণশক্তি হ্রাস, স্ট্রেস হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। শিশু, বয়স্ক ও অসুস্থদের ওপর এর প্রভাব মারাত্মক। বাংলাদেশের দীর্ঘ উপকূলীয় এলাকা হতে পারে এই ধরনের প্রশিক্ষণের উপযুক্ত স্থান। এই দুর্ঘটনার পর দ্রুত সরকারের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এদিকে চীনের তৈরি এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানকে চেংডু জে-৭ সিরিজের সবচেয়ে উন্নত সংস্করণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি সোভিয়েত আমলের মিগ-২১-এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি, যে মডেলটি বহু দেশে বহু দুর্ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশ ২০১১ সালে চীনের কাছ থেকে ১৬টি এফ-৭ বিজিআই কেনে এবং ২০১৩ সালে সেগুলো বহরে যুক্ত হয়। একই বছর চীন নিজেই এই মডেলের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। বলা হয়, এফ-৭ বিজিআই বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর 'স্বল্প ব্যয়ে আধুনিকায়নের'
সাহসী পাইলটদের জীবন নিয়ে জুয়া খেলা। এটি কেবল বাজেটের প্রশ্ন নয়-এটি ন্যায়ের প্রশ্ন। জীবনের প্রশ্ন।
বিশ্লেষকদের মতে আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইসিএও) নির্দেশনা অনুযায়ী, বিমানবন্দরের চারপাশে একটি নির্দিষ্ট এলাকাকে 'বাফার জোন' বা নিরাপত্তা বেষ্টনী হিসেবে রাখা বাধ্যতামূলক, যেখানে স্কুল, হাসপাতাল বা ঘনবসতিপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। অথচ এ নগরীতে রানওয়ের পাশে বা কাছাকাছি স্থানে রয়েছে আবাসিক ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা। সেক্ষেত্রে মাইলস্টোন ট্রাজেডি আমাদের জন্য যে সতর্কবার্তা দিয়েছে, সেটা অনুধাবন করতে হবে সংশ্লিষ্টদের।
এই ধরনের আকস্মিক ও ভয়াবহ দুর্ঘটনা শিশু-কিশোরদের ওপর গভীর মানসিক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে যারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল, আহত হয়েছে বা চোখের সামনে বন্ধুবান্ধব, সহপাঠীদের অসহায় অবস্থায় দেখেছে-তাদের মধ্যে অ্যাকিউট স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (ASD), ট্রমাটিক স্ট্রেস, দুঃস্বপ্ন, আতঙ্ক, চমকে ওঠা, ঘুমে সমস্যা, স্কুলে যেতে না চাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। মনো-দৈহিক-সামাজিক পদ্ধতিতে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার আক্রান্তদের চিকিৎসা করতে হবে। কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি, আই মুভমেন্ট ডিসেনসিটাইজেশন রিপ্রসেসিং থেরাপি (ইএমডিআর), লং টার্ম এক্সপোজার থেরাপির মাধ্যমে পিটিএসডির চিকিৎসা দীর্ঘদিন চালিয়ে যেতে হয়।
লেখক:
ফিকামলি তত্ত্বের জনক শিক্ষাবিদ, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ওয়াইল্ডলাইফ বিশেষজ্ঞ।
মোঃ কামরুজ্জামান মিলন
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক তুহিন প্রিন্টিং প্রেস ফকিরাপুল ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
ই-মেইল: 𝐝𝐚𝐢𝐧𝐢𝐤𝐚𝐥𝐨𝐤𝐢𝐭𝐨𝐧𝐞𝐰𝐬@𝐠𝐦𝐚𝐢𝐥.𝐜𝐨𝐦
ই-পেপার: 𝐞𝐩𝐚𝐩𝐞𝐫.𝐝𝐚𝐢𝐧𝐢𝐤𝐚𝐥𝐨𝐤𝐢𝐭𝐨𝐧𝐞𝐰𝐬.𝐜𝐨𝐦
ওয়েবসাইট: 𝐰𝐰𝐰.𝐝𝐚𝐢𝐧𝐢𝐤𝐚𝐥𝐨𝐤𝐢𝐭𝐨𝐧𝐞𝐰𝐬.𝐜𝐨𝐦
মোবাইল: ০১৯২৭-৩০২৮৫২/০১৭৫০-৬৬৭৬৫৪
আলোকিত মাল্টিমিডিয়া লিমিটেড