বান্দরবান সদর প্রতিনিধিঃ
প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে অংশ নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সেখানে বাফুফে ঘোষিত ২৪ সদস্যের প্রাথমিক দলে জায়গা করে নিয়েছেন প্রেনচ্যুং ম্রো। এর মধ্য দিয়ে ইতিহাসে নাম লেখালেন তিনি। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া ম্রো নৃগোষ্ঠীর প্রথম তরুণ তিনি।
প্রেনচ্যুং স্কো এখন ঘাম ঝরাচ্ছেন মিরপুরের মাঠে। পাহাড়ি উপত্যকার মতোই উত্থান-পতনের জীবন তাঁর। ৭ আগস্ট দিনটি অক্ষয় হয়ে থাকবে অদম্য এই তরুণের মানসপটে। জীবনে এখান পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সুখবর পেয়েছেন এদিন। প্রথমবারের মতো জাতীয় ফুটসাল দল গঠন করেছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। ২৪ সদস্যের সেই দলের ৩ নম্বরে আছে বান্দরবান পার্বত্য জেলা, বান্দরবানের সদরে, সুয়ালক ইউনিয়নে এই ফুটবলারের নাম। এর মধ্য দিয়ে ইতিমাসের পাতায় নাম লেখালেন প্রেনটাং। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া ম্রো নৃগোষ্ঠীর প্রথম তরুণ তিনি।
আগামী সেপ্টেম্বরে ফুটসালে প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে অংশ নেবে বাংলাদেশ। প্রথমবার বলেই ট্রায়ালের মাধ্যমে দল গঠন করা হয়েছে। দুই দিনের উন্মুক্ত ট্রায়ালে অংশ নিয়েছেন প্রায় ৬০০ খেলোয়াড়। সেখান থেকে ২৪ সদস্যের প্রাথমিক দলে জায়গা করে নিয়েছেন গ্রেনচ্যুং মো। অথচ একসময় হতাশায়
মুষড়ে পড়েছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন আর বুঝি মাঠে ফেরা হবে না।
কিন্তু কেন?
সেই গল্প পরে শোনা যাক। আগে চলুন, ঘুরে আসি বান্দরবানের জেলা, বান্দরবান সদর, সুয়ালক ইউনিয়নে, লামারপাড়া থেকে। সেখানেই জন্ম প্রেনচাংয়ের। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট। মা-বাবা ছিলেন জুম চাষি। বাবা পিয়াচন। মো একটি এনজিওতেও কাজ করতেন। ছোটবেলা থেকেই ভালো ফুটবল খেলতেন। পাসিং, ড্রিবলিংয়ে পাড়ার সমবয়সীদের কেউ পেরে উঠত না তাঁর সঙ্গে। এ জন্য অনেকেই 'খ্যাপ' খেলাত নিয়ে যেত প্রেনচ্যংকে। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরের এক সকালের ঘটনা তাঁর জীবনটাকেই নাড়িয়ে দিল। মায়ের সঙ্গে জুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। পথে তাঁর মা হঠাৎ স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। চিকিৎসকরা বলে দিলেন, তিনি আর স্বাভাবিক জীবন ফিরবেন না। চিরদিনের জন্যই শয্যাশায়ী হয়ে গেছেন প্রেনড্রাংয়ের মা তুময়েন মোঃ প্রেনচ্য। তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।
মায়ের সঙ্গে বন্দি জীবন
মায়ের অসুস্থতা কিশোর প্রেনচ্যুংয়ের দুনিয়াটা বদলে দিল। পড়াশোনার সূত্রে অন্য বড় ভাই-বোনরা তখন এলাকার বাইরে। মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো ছেলেটি হঠাৎ ঘরবন্দি হয়ে পড়লেন। খাওয়ানো, গোসল করানো, পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে মায়ের সব কাজই সামাল দিতে হতো অতটুকু প্রেনানংকে। স্কুল থেকে ফিরে মাকে খাওয়ানো, গোসল করানোর কাজ করতেন। বিকেলে বন্ধুরা খেলতে ডাকত, কিন্তু যাওয়ার উপায় ছিল না। মায়ের অসুখের পর থেকে আর্থিক বিপর্যয় নেমে আসে পরিবারে। গয়না থেকে শুরু করে বেচার মতো যা ছিল, প্রায় সবই বিক্রি করতে হয়েছে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে। গৃহকর্তা পিয়াচ্যং মোর একার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল সব সামলানো। ছেলে স্কুলে থাকার সময়টায় স্ত্রীর পাশে থাকতেন পিয়াচাং। এভাবে চাষবাস ও ঘরের কাজে বেশি সময় দিতে গিয়ে একসময় চাকরিটা হারালেন।
আবার খ্যাপে
চাকরি হারানোর পর একেবারে দিশাহারা অবস্থা হয়ে পড়ে গ্রেনচ্যুংয়ের বাবার। এই অবস্থায় নবম শ্রেণি থেকে আবার খ্যাগে খেলা শুরু করেন প্রেনচূনং। খেলে যা পেতেন, সবই তুলে দিতেন বাবার হাতে। এসএসসির পর ভর্তি হলেন বান্দরবান সরকারি কলেজে। বাড়ি থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে কলেজ। বেশির ভাগ দিনই কিছু মুখে না দিয়েই সকাল ৬টার দিকে বেরিয়ে পড়তেন। মাইল দুয়েক হাঁটার পর বাস।
পড়া ছাড়তে চাননি
এইচএসসির পর সহপাঠীদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের জন্য চট্টগ্রামে চলে যান। কিন্তু প্রেনচ্যুংয়ের সে উপায় ছিল না। টাকা তো ছিলই না আবার বাড়িতে থাকে সেবা-যত্ন করার মানুষও নেই। এইচএসসির ফল প্রকাশের পর মোবাইল কেনার জন্য প্রেনচ্যুংকে সাত হাজার টাকা দিয়েছিলেন তাঁর বড় বোন। মোবাইল না কিনে সেই টাকা নিয়ে চলে গেলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। বড় ভাই-বোনরা চেয়েছিলেন পড়াশোনায় মতি টেনে যেন একটি চাকরিতে ঢোকেন তিনি। কিন্তু মনেপ্রাণে পড়তে চেয়েছিলেন এই তরুণ। ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগে ভর্তির সুযোগ পান প্রেনটাং। প্রথম বর্ষের শুরুতেই একদিন খবর পেলেন, বাবা আর নেই। এর মাস চারেকের মাথায় চলে গেলেন মা-ও।
লীগেও খেলেছেন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে ২০১৮ সাল থেকে আগ বিশ্ববিদ্যালয় টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ পান প্রেনচ্যুং। সেবার তৃতীয় হয়েছিল তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকায় অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু চ্যাম্পিয়নশিপে বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে মাঠ মাতিয়েছিলেন প্রেনচ্যুং। ২০২২ সালে প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সেবার দলের সহ-অধিনায়ক ছিলেন প্রেনচ্যুং। বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লীগে (বিসিএল) ঢাকা ফোরটিজ এফসির হয়ে খেলেছেন। ব্রাদার্স
ইউনিয়নের হয়ে খেলেছেন চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার লীগে। ২০২৩ সালে খেলেছেন কিশোয়ান এফসির হয়ে। আক্রমণভাগের খেলোয়াড় প্রেনচ্যুং মাঠের দুই উইংয়েই স্বচ্ছন্দ। ফুটবলে তাঁর আইডলন পর্তুগিজ তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালডো।
নাম লিখিয়েছেন গিনেসে
২০২২ সালে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম ওঠে বান্দরবানের এই তরুণের। মিনিটে ২০৮ বার টোকা দিয়ে ফুটবল শূন্যে ভাসিয়ে রেখে রেকর্ড গড়েছিলেন তিনি। প্রেনট্রাং বলেন,
প্রেনচ্যুংয়ের সামনে আরেক পাহাড়
১৮ মে ২০২৪, অবসরের সেই প্রতিবেদন
গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের ঘটনা সম্ভবত আমাদের পাহাড়িদের থেকে এখন পর্যন্ত কারো নেই। ম্রো জাতিগোষ্ঠীকে কেউ তেমন একটা চেনে না। ফুটবলের মাধ্যমে তাদের দেশবাসীর সঙ্গে পরিচিত করাতে চাই।'
যে পাহাড়ে আটকে ছিলেন
যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। নানা জটিলতায় প্রথমবার যাওয়া হয়নি। বিশ্বের গৃহহীনদের সহায়তার লক্ষ্যে আয়োজিত এই প্রতিযোগিতার ২০২৪ সালের আসর বসেছিল দক্ষিণ কোরিয়ায়। সে জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন প্রেনচ্যুং। কিন্তু একটি টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়ে বাজে ট্যাকেলে গুরুতরভাবে আহত হন সে বছরের ১৮ এপ্রিল। কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল। ডান পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে। হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপে অংশগ্রহণ তো কূলে গেলই, আদৌ আর মাঠে ফিরতে পারবেন কি না, তা নিয়েও সংশয়ে ফুটবলপাগল এই তরুণ। যত দ্রুত সম্ভব দেশের বাইরে গিয়ে অপারেশন করানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। এ জন্য সাত লাখ টাকার মতো লাগত। কিন্তু অর্থাভাবে আটকে ছিল চিকিৎসা। অনেক কষ্ট করে নিজের চিকিৎসা খরচ যোগাড় করেন
আবার মাঠে
অপারেশনের পর বছরখানেকের মতো ছিলেন মাঠের বাইরে। পুনর্বাসনের কঠিন পাহাড় পেরিয়ে আবার মাঠে নেমেছেন প্রেনচ্যুং। গত ১১ আগস্ট থেকে জাতীয় ফুটসাল দলের ক্যাম্প শুরু হয়েছে। চলবে ১৮ তারিখ পর্যন্ত। আপাতত চূড়ান্ত দলে জায়গা পাকা করতে চান। তবে প্রেনচ্যুংয়ের মূল লক্ষ্য হামজা-জামালদের সঙ্গী হয়ে বাংলাদেশ
মোঃ কামরুজ্জামান মিলন
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক তুহিন প্রিন্টিং প্রেস ফকিরাপুল ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
ই-মেইল: 𝐝𝐚𝐢𝐧𝐢𝐤𝐚𝐥𝐨𝐤𝐢𝐭𝐨𝐧𝐞𝐰𝐬@𝐠𝐦𝐚𝐢𝐥.𝐜𝐨𝐦
ই-পেপার: 𝐞𝐩𝐚𝐩𝐞𝐫.𝐝𝐚𝐢𝐧𝐢𝐤𝐚𝐥𝐨𝐤𝐢𝐭𝐨𝐧𝐞𝐰𝐬.𝐜𝐨𝐦
ওয়েবসাইট: 𝐰𝐰𝐰.𝐝𝐚𝐢𝐧𝐢𝐤𝐚𝐥𝐨𝐤𝐢𝐭𝐨𝐧𝐞𝐰𝐬.𝐜𝐨𝐦
মোবাইল: ০১৯২৭-৩০২৮৫২/০১৭৫০-৬৬৭৬৫৪
আলোকিত মাল্টিমিডিয়া লিমিটেড