প্রিন্ট এর তারিখঃ জুলাই ১২, ২০২৫, ৮:১৬ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ জুলাই ৮, ২০২৫, ৪:২৬ অপরাহ্ণ
বিশেষ প্রতিনিধিঃ
শুধু জমি দখল নয়, পরিবেশ ধ্বংস, খাল-জলাশয়ের পথ রুদ্ধ করে কারখানা গড়ে তোলা এবং কৃষিজমিতে জলাবদ্ধতার ফাঁদ তৈরি এমন একাধিক অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা গাজীপুরের শ্রীপুরে অবস্থিত এক্স সিরামিকস লিমিটেড সম্প্রতি পেয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ‘গ্রীন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড’। এতে বিস্ময়, ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে স্থানীয় সমাজে।
এই পুরস্কার ঘোষণার পর থেকেই সোচ্চার হয়েছেন শিক্ষক, সাংবাদিক, পরিবেশকর্মী ও সংস্কৃতিকর্মীরা। পরিবেশ অধিদপ্তরের নিজস্ব প্রতিবেদনে একাধিকবার প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে পরিবেশবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকলেও কীভাবে তারা রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়—তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সকলে।
অভিযোগ: খাল দখল, কৃষিজমিতে জলাবদ্ধতা, খালকে বর্জ্যের নালায় পরিণতকরণ স্থানীয়দের অভিযোগ, এক্স সিরামিকস কৃষিজমির গর্ভ চিরে প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। পাশের খালকে বর্জ্য ফেলার ড্রেনে রূপান্তর করা হয়েছে। এর ফলে শ্রীপুরের একাধিক বসতবাড়ি ও কৃষিজমি বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধ হয়ে পড়ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনেই দখল-দূষণের প্রমাণ পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে: প্রতিষ্ঠানটি প্রাকৃতিক খালের প্রবাহ পথ রুদ্ধ করে গড়ে উঠেছে
জলাশয় দখলের প্রমাণ মিলেছে খালের পানিতে বর্জ্য মিশিয়ে দূষণ সৃষ্টি করা হয়েছে পরিবেশের উপর দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে
এমন অবস্থায় ‘সবুজ কারখানা’র মতো উচ্চমর্যাদার পুরস্কার পাওয়াকে ‘নীতির পরিহাস’ বলে উল্লেখ করেছেন স্থানীয় পরিবেশকর্মীরা।
নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ ও লিখিত চিঠি
৩০ জুন ২০২৫ তারিখে একাধিক শিক্ষক, সাংবাদিক ও পরিবেশসেবী শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর লিখিত চিঠি দিয়ে চারটি দাবি জানিয়েছেন। এতে স্বাক্ষর করেছেন:
সাঈদ চৌধুরী, সভাপতি, বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল (শ্রীপুর) রানা মাসুদ, সভাপতি, শ্রীপুর সাহিত্য পরিষদ
খোরশেদ আলম, চেয়ারম্যান, রিভার অ্যান্ড ন্যাচার ফাউন্ডেশন শাহান সাহাবুদ্দিন, কবি, লেখক ও সাংবাদিক
সাঈদ চৌধুরী বলেন, “যাদের নামে নদী-খাল দখলের অভিযোগ প্রমাণিত, তাদের পুরস্কৃত করা মানে রাষ্ট্র নিজেই আইন ভেঙে ফেলছে। আমরা এর তদন্ত ও অ্যাওয়ার্ড বাতিল চাই।”
রানা মাসুদ বলেন, “পরিবেশবিনাশী কারখানাকে পুরস্কার দিলে শুধু প্রকৃতি নয়, শ্রীপুরের সাংস্কৃতিক ইতিহাসও অপমানিত হয়।”
খোরশেদ আলম বলেন, “গ্রীন অ্যাওয়ার্ড কীভাবে এলো? এটি কেবল অসততার উদাহরণ নয়, বরং পরিবেশের নামে বাণিজ্যের দৃষ্টান্ত।”
শাহান সাহাবুদ্দিন বলেন, “সবুজ সনদ তখনই অর্থবহ, যখন তা প্রকৃত পরিবেশ রক্ষাকারীদের দেওয়া হয়। নদী দখল ও দূষণের পুরস্কার কোনো সভ্য রাষ্ট্র দিতে পারে না।”
চিঠিতে ৪টি দাবি উত্থাপন করা হয়েছে:
১. এক্স সিরামিকসকে দেওয়া ‘গ্রীন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড’ অবিলম্বে বাতিল করতে হবে
২. পুরস্কার বাছাই কমিটি ও সুপারিশকারীদের নাম প্রকাশ করতে হবে
৩. দখল ও দূষণের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রকাশ করতে হবে
৪. ভবিষ্যতে অনিয়ম রোধে কঠোর আইন ও মনিটরিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে
পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে আমাদের প্রতিবেদন অগ্রাহ্য করা হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “আমাদের প্রতিবেদনে খাল দখল, দূষণসহ একাধিক সুপারিশ ছিল। তবে মন্ত্রণালয়ের গঠিত অ্যাওয়ার্ড কমিটি সেগুলো বিবেচনায় নেয়নি।”
শ্রম মন্ত্রণালয়ের নীরবতা, প্রভাবশালীর ভূমিকায় সন্দেহ
শ্রম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি। তবে কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতার ‘সুপারিশ’ থাকায় এক্স সিরামিকস মনোনীত হয়।
নীতিমালার লঙ্ঘন পুরস্কারই প্রশ্নবিদ্ধ গ্রীন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড নীতিমালা ২০২২’-এ বলা আছে:পরিবেশ অধিদপ্তরের অনাপত্তি সনদ ছাড়া মনোনয়ন গ্রহণযোগ্য নয় দূষণের প্রমাণ মিললে পুরস্কার বাতিলযোগ্য মিথ্যা তথ্য দিলে প্রতিষ্ঠান কালো তালিকাভুক্ত হবে
পরিবেশকর্মীদের দাবি, এক্স সিরামিকসের ক্ষেত্রে এসব শর্তই লঙ্ঘিত হয়েছে। এটি শুধু গাজীপুর নয়, বাংলাদেশের পরিবেশনীতির ওপরই এক বড় আঘাত।